পুরান ঢাকায় এখনো বাড়ির ছাদে-কার্নিশে ঘুরে বেড়ায় রিসাস বানর। সম্প্রতি কোতোয়ালি থানার কৈলাস ঘোষ লেনে। ছবি: প্রথম আলো
১ কোটি ৮০ লাখ মানুষের শহর ঢাকা। এই কংক্রিটের জঙ্গলে, মানুষের দঙ্গলে বন্য প্রাণীর স্থান হওয়ার কথা নয়। তবু তারা আছে বিশ্বের চতুর্থ ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরে।
এই প্রাণীদের কেউ কেউ আছে ছন্নছাড়াভাবে, সংখ্যায় দু-চারটি। কেউ আছে লক্ষ-কোটিতে। হ্যাঁ, সত্যি সত্যি কোটি স্তন্যপায়ী বন্য প্রাণী আছে ঢাকায়। এদের সামগ্রিক নাম রডেন্ট। রডেনসিয়া বর্গের এই প্রাণীগুলোর ওপরের পাটিতে দুটি ও নিচের পাটিতে দুটি ছেদন দাঁত আছে। এই দাঁতগুলো সব সময় লম্বা হয়ে বাড়ে। কারণ, এই প্রাণীটির জীবনধারণের জন্য সারাক্ষণ কাটাকাটি করতে হয়। এতে দাঁতের ক্ষয় হয়। আবার ক্ষয়ে দাঁতের বৃদ্ধি নিবারণ হয়। এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝে গেছেন, এরা ইঁদুর জাতি। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে এরাই সবচেয়ে বড় পরিবার। এই পরিবার দখল করে আছে বন্য প্রাণীর ৪০ শতাংশ।
ধেড়ে ইঁদুর
পুরান ঢাকার, বিশেষ করে যেসব এলাকায় গুদাম আছে, স্যাঁতসেঁতে ঘর আছে, সেখানেই দেখতে পাবেন ধেড়ে ইঁদুর (মেঠো ইঁদুর/খেত ইঁদুর bandicata bengalensis)। আকারে বড়সড়। রং বালু বাদামি; কখনো বাদামি, কালচে, লালচে হয়। মূলত শস্যদানাভোজী হলেও অনেক অনিষ্টকর পোকামাকড় খায়। কালো ইঁদুরের মতো এরাও প্লেগ, টাইফাস ছড়াতে ওস্তাদ। এরা লেজসহ ৪০ সেন্টিমিটার, ওজন ৩৫০ গ্রাম।
কালো ইঁদুর
মাঝারি ওজনের কালো ইঁদুরও যথেষ্ট পরিমাণে আছে ঢাকা শহরে। এরা কালচে বাদামি রঙের। বুকের দিকের রং হালকা। শরীরের (১২ থেকে ১৮ সেন্টিমিটার) চেয়ে লেজ (১৫ থেকে ২২ সেন্টিমিটার) বড়।
এই ইঁদুরের উৎপত্তি উপমহাদেশে হলেও জাহাজে চড়ে এরা প্রায় সব মহাদেশে পৌঁছেছে। এই প্রাণীটি রক্তে অনেক দিন মানুষের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া ধারণ করে রাখতে পারে। প্লেগ ছড়াতে এদের জুড়ি নেই। সর্বভুক এ ইঁদুর শস্যদানা, ফলফলারি, গাছের নরম অংশ, বীজ, পাতা, ব্যাঙের ছাতা, নানা মেরুদণ্ডী-অমেরুদণ্ডী প্রাণী খায়।
নেংটি ইঁদুর
স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতা হলে নেংটি ইঁদুর একটি স্থান পাবে। ঢাকা শহরে এরা বেশ আছে। বৈজ্ঞানিক নাম mus musculus. খুবই ছোটখাটো প্রাণী। লম্বায় শরীর তিন থেকে সাড়ে তিন ইঞ্চি, লেজ দুই থেকে সাড়ে তিন ইঞ্চি। এরা মূলত শস্যভোজী, তবে আমিষও খায়। একবারে ছয় থেকে আটটি বাচ্চা জন্ম দেয়। বছরে আট-দশবার বাচ্চা তোলা অসম্ভব না।
জংলি অবস্থায় এরা আট-নয় মাস বাঁচে। ধেড়ে ইঁদুর, কালো ইঁদুর এদের পেলেই মেরে খেয়ে নেয়। এরাও রোগ ছড়ায়। তবে ধেড়েদের মতো অতটা না।
গবেষণাগারে নানা রঙের যেসব ইঁদুর দেখা যায়, তাদের আদিপুরুষ এই নেংটি ইঁদুর।
ছুছুন্দর বা চিকা
রাজনৈতিক কর্মীরা রাতে দেয়ালে স্লোগান লেখেন। পুলিশ এগিয়ে এলে তাঁরা বলতেন, ‘চিকা মারছি’। গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে রাতের দেয়াল লিখনশিল্প ‘চিকা মারা’ হিসেবে খ্যাত। ছুছুন্দর বা চিকা (suncus murinus) নামের দুর্ভাগা প্রাণীটি এখনো কিছু পরিমাণে এ শহরে টিকে আছে।
সাদাটে বাদামি বা হালকা বাদামি পশমে আবৃত ইঁদুরের মতো দেখতে কিন্তু সুচালো মুখের চিকার লেজে, নাকের ওপর শক্ত পশম আছে। এরা কুখ্যাত বিশ্রি দুর্গন্ধের জন্য। শরীরের দুই পাশে তরল গন্ধথলি আছে। এই গন্ধ এত বিকট যে বিড়াল সাধারণত এদের ধরতে চায় না। সাপ ভুল করে ধরলেও ছেড়ে দেয়। এরা ইঁদুরের চেয়ে দ্রুত কামড়ায়, সম্ভবত এদের লালায় সামান্য বিষ আছে। এরা তেলাপোকা, নানা কীটপতঙ্গের যম। এরা কিছুটা উপকারী হলেও এদের বদভ্যাস হলো মানুষের রান্নাঘরে বিষ্ঠা ত্যাগ করে।
বাদুড়
জেমস টেলর তাঁর অ্যা স্কেচ অব দ্য টোপোগ্রাফি অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক অব ঢাকা বইয়ে (১৮৪০ সালে) জানিয়েছেন, তিনি ঢাকায় রঙিন বাদুড় দেখেছেন। রঙিন বাদুড় এখন বাংলাদেশের কোথাও দেখা যায় না। তবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাদুড় ‘উড়ন্ত শিয়াল’ ঢাকা শহরেও দেখা যায়। রমনা পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেনসহ আরও কিছু এলাকায় বড় বাদুড়ের নিবাস। বড় বাদুড় যেমন রোগ ছড়ায়; আম, লিচু, পেয়ারাও খেয়ে ফেলে।
চামচিকা
আমরা যাকে চামচিকা বলি (pipistrellus coromandra), সেও এক জাতের উপকারী বাদুড়। এরা প্রচুর মশা খায়। এ ছাড়া আরও দুটি বাদুড় ঢাকায় থাকতে পারে।
বনরুই
ঢাকার কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবের আশপাশ, মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন ও সন্নিহিত অঞ্চল বেশ কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবাসস্থল। এদের মধ্যে আইইউসিএনের অত্যন্ত বিপন্ন তালিকাভুক্ত চায়নিজ প্যাঙ্গোলিন (manis pentadactyla), বগ্রকীট বা বনরুই অন্যতম। এই প্রাণীটি সাধারণত কোনো চিড়িয়াখানায় দেখতে পাওয়া যায় না। কারণ, এদের খাবার হলো পিঁপড়া আর উইপোকা। এত পিঁপড়া, উইপোকা চিড়িয়াখানার পক্ষে জোগান দেওয়া সম্ভব না।
বনরুইয়ের শরীর দেড় ফুটের মতো লম্বা। লেজখানা ১৪ ইঞ্চির মতো লম্বা হয়। ওজন দুই থেকে সাত কেজি পর্যন্ত হয়। অনেকটা রুই মাছের আঁশের মতো আঁশ এদের শরীরে ১৮ সারিতে দেখা যায়। আঁশের ফাঁকে ফাঁকে থাকে শক্ত লোম। বছরে একবার একটিমাত্র বাচ্চা প্রসব করে বনরুই।
পাতিশিয়াল
ওপরে উল্লিখিত অঞ্চল ছাড়াও মিরপুর সিরামিক ফ্যাক্টরি এলাকায় শিয়ালের দল দেখা যায়। ইংরেজি নাম গোল্ডেন জ্যাকেল (canis aureus indecus), বাংলায় পাতিশিয়াল নামে আমরা একে চিনি। বাংলা মিথে শিয়াল খুব চালাক-চতুর হলেও বাংলাদেশে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে শিয়ালের বুদ্ধিবৃত্তি কাজে আসেনি। গ্রামগঞ্জেও শিয়াল বিপন্ন, ঢাকা শহরে আর কদিন থাকতে পারবে
খ্যাঁকশিয়াল
খ্যাঁকশিয়াল নামের খুবই সুদর্শন প্রাণীটির দু-একটি এখনো ঢাকায় থাকতে পারে। বৈজ্ঞানিক নাম valpes Bangalensis। এদের শরীর লম্বায় ১৮ ইঞ্চি। লেজ ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। শরীরের রং হালকা বাদামি থেকে পাংশুটে বাদামি। মুখ সরু, খাড়া কান বেশ বড় বড়। নিশাচর এই প্রাণীটি ছয় থেকে আট বছর বাঁচে। কাঁকড়া, ইঁদুর, সাপখোপ, উইপোকা, পোকামাকড়, ফলপাকুড়, ছোট পাখি পেলে খেয়ে নেয়।
রিসাস বানর
ঢাকা শহরের সবচেয়ে পরিচিত, প্রচারিত কিন্তু নিগৃহীত বন্য প্রাণী বোধ করি রিসাস বানর (macaca mulatta)। জংলি বানর হলেও অল্প সময়ের মধ্যেই মানুষের মধ্যে নিজেদের জন্য একটুখানি জায়গা করে নেয়। এরা খাবার যতটা খায়, নষ্ট করে তার চেয়ে বেশি। ঢাকাবাসীর অপ্রিয় সঙ্গী এরা। লোকজন এদের দেখতে পেলেই জান্তব আগ্রহে ঢিল ছুড়তে শুরু করে। ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি বানরই আহত শরীরে লুকানোর চেষ্টা করে। এটা করতে গিয়ে বৈদ্যুতিক শক খেয়ে মারা পড়ে অনেকে। পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার সাধনা ঔষধালয়ে এদের নিরাপদ রাত্রিবাসের নিশ্চয়তা আছে। বানরের সংখ্যা এত কমেছে যে আগামী দশকে হয়তো এদের হদিস থাকবে না
বেজি
বেজি ছোট হলে বৈজ্ঞানিক নামটি বেশ বড়—herpestes auropunctatus. এরা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়েও পড়েছে। এরা ইঁদুর, ইঁদুরের বাচ্চা খায়। পৃথিবীর নানা দেশের কৃষক খেত বাঁচানোর জন্য এদের নিয়ে সেসব দেশে ছেড়ে দিয়েছেন।
ঢাকার বেজি এশিয়ার সবচেয়ে ছোট বেজি। শরীর ৩০ সেমি, লেজ ২৫ সেমি পর্যন্ত হতে পারে। ওজন খুব বেশি হলে ৫০০ গ্রাম। পশমের রং লালচে হলদে, নয়তো বাদামি লাল। লোমের বিন্যাসে হালকা-গাঢ় রঙের চক্র দেখা যায়। পুরান ঢাকা, ইস্কাটন, মগবাজার, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর এমনকি বনানী-গুলশানেও এ বেজি দেখা যায়।
বড় বেজি বা herpestes edwardsi খুব কম সংখ্যায় হলেও গুলশান-বনানীতে এখনো কিছু আছে।
কাঠবিড়ালি
গত শতকের ষাটের দশকে ঢাকা শহরে আমরা কাঠবিড়ালি দেখেছি বলে মনে পড়ে না। কাজী নজরুল ইসলামের ‘লিচু-চোর’ কবিতার মাধ্যমেই আমাদের কাঠবিড়ালির সঙ্গে পরিচয়। সম্ভবত আশির দশকে গুলশানে প্রথম ইরাবতী কাঠবিড়ালি (calloscurress pygerythrues) দেখতে পাই। এই কাঠবিড়ালিটি দেশের প্রায় সব ধরনের বনে আছে। এমনকি পূর্ব সুন্দরবনেও আছে।
ঢাকায় যখন যশোর, ঝিনাইদহ থেকে ট্রাকে করে কলা আসতে শুরু করে, তখন কলার সঙ্গে এরাও এসে ঢাকায় বসতি গড়ে। এরা পাঁচ ডোরা কাঠবিড়ালি (funambulus pennantii). মিরপুর চিড়িয়াখানায় খাঁচার বাইরে, বোটানিক্যাল গার্ডেনে এদের খুব দেখতে পাওয়া যায়। সন্দেহ করি তিন ডোরা কাঠবিড়ালি (funambalus palmarum) ঢাকায় আসতে শুরু করেছে।
পাখি
বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ কূটনৈতিক উইলিয়াম হার্ভে ও ডব্লু জি হার্ভে ছিলেন দক্ষ পাখি দেখিয়ে। Birds in Bangladesh নামে তাঁরা একটি বই লিখেছিলেন। তাঁরা তখন শুধু ঢাকা শহরেই ষাট প্রজাতির পাখি দেখতে পেয়েছিলেন। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে একদল নবীন-প্রবীণ প্রতিভাবান পাখিবিশেষজ্ঞ ঢাকা শহরে শতাধিক পাখির খোঁজ পেয়েছেন। বিশেষ করে বোটানিক্যাল গার্ডেনটি দাঁড়িয়ে ওঠায় পাখির সংখ্যা অনেক বেড়েছে।
কাছিম, সাপ, শজারু এবং...
দিন কয়েক আগে শাহবাগ দিয়ে যাচ্ছিলাম। জাদুঘরের কাছে একটা ছোট পুকুরে একটা মোটা ডাল ভেসে ছিল। তাতেই বসে ছিল কাছিম (melanchelys trijuga)। পাশেই রোদ পোহাচ্ছে একটি ঢোড়া সাপ (xenochrophis piscater.) কাছে তো কোনো বড় পুকুর বা নদী নেই, এরা এল কোথা থেকে!
বাংলাদেশে পাওয়া যায় রডেনশিয়া পরিবারের সবচেয়ে বড় সদস্য ইন্ডিয়ান ক্রেস্টেড পরকুপাইন (hystrix indica) বা শজারু। রাতে চলাফেরা করা প্রাণীটি ষাটের দশকে মিরপুর, গুলশান, বাড্ডা, বর্তমান উত্তরা এলাকায় যথেষ্ট পরিমাণ দেখা যেত। আজকাল কালেভদ্রে মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের আশপাশে বিপন্ন অবস্থায় ধরা পড়ে। পুরোপুরি নিরামিষাশী এই প্রাণীটির শরীর স্তরে স্তরে সাজানো লম্বা কাঁটায় আকীর্ণ। মিথ আছে, শজারুর পিছু ধাওয়া করলে এরা ধাওয়াকারীর দিকে কাঁটা ছুড়ে মারে। মিছে কথা।
|
No comments